বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ রচনা

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ রচনা।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের একটি অনতম সমস্যা। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ রচনা ৬ষ্ঠ, ৭ম, ৮ম, ৯ম, এসএসসি ও এইচএসসি শ্রেণির জন্য। নিন্মে রচনাটি সহজ ও সাবলীল ভাষায় লিখা হলো।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ রচনা।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ রচনা।

    ভূমিকা

    সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশ। আমাদের এই বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অভরায়ন্য কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর একটি অন্যতম সমস্যা। শুধু আমাদের দেশই নয় বিশ্বের প্রায় সকল দেশই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলতে এমন কিছু দুর্ঘটনা বা বিপর্যয়কে বোঝায়, যা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম মেনে ঘটে এবং যার পিছনে মানুষের প্রত্যক্ষ কোন হাত বা  ভূমিকা থাকে না। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য নানান সময়ে নানান প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়। যার মধ্যে খরা,বন্যা,ঘূর্ণিঝড় ,জলোচ্ছ্বাস,ভূমিধস ভূমিকম্প, নদীভাঙ্গন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। 

    বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ

    প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে থাকে মূলত প্রাকৃতিক কারণে। এটি দেশের ভৌগলিক অবস্থান, জলবায়ুর প্রভাব, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন তথা সামগ্রিক প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর নির্ভর করে ঘটে থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মূলত এর ভৌগলিক অবস্থা্ন, জলবায়ুর পরিবর্তন, ভূমির গঠন, নদী-নালা ইত্যাদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশ প্লাবন সমভূমি দ্বারা গঠিত। এছাড়া ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ ভারত ও মিয়ানমারের প্লেটের সীমানার কাছে অবস্থিত হওয়ায় দেশে ভূমিকম্প হওয়ার প্রবণতাও বেশি। তাছাড়া বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া অসংখ্য নদী-নালা আঁকা বাঁকা হয়ে প্রবাহিত হওয়ার কারণে বন্যা ও নদী ভাঙ্গনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা অনেক বেশি।

    খরা

    বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে খরা একটি অন্যতম ও ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এই অবস্থার সৃষ্টি হয় মূলত অনাবৃষ্টি এবং ভূ-গর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার ফলে । এর ফলে ফসলের ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এমনকি অনেক সময় গাছপালাও পানির অভাবে শুকিয়ে যায়। সাধারণত আমাদের দেশের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ সবচেয়ে বেশি খরার সম্মুখীন হয়। তবে বাংলাদেশ সরকার কতৃক বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করার পরে রাজশাহী বিভাগ এবং রংপুর বিভাগের বেশ কিছু অঞ্চলে খরাকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। তবে এখনো উত্তরাঞ্চলের বহু জেলায় খরা পরিস্থিতি্র সৃষ্টি হয় ও যা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে। খরার সময় অত্যাধিক তাপদাহের ফলে নানা প্রকার রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। পাশাপাশি বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাবে মানুষের ও পশুপাখির অনেক কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়।

    বন্যা

    আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাস বর্ষাকাল। এসময় বাংলাদেশে অনেক বৃষ্টি হয়। বৃষ্টির পাশাপাশি পাহাড়ি ঢলের কারণে বাংলাদেশের নদীগুলো ভরে টইটুম্বুর হয়ে যায় এবং এই অত্যাধিক পানির কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা দেখা দেয়। বন্যাকবলিত অঞ্চলগুলোতে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। তাছাড়া ফসলেরও ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। বন্যার ফলে জনপদের ঘরবাড়ি ও রাস্তা ঘাট নষ্ট হয়ে যায়। অনেক গৃহপালিত পশু হারিয়ে যায় এবং প্রাণ হারায়। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি বন্যা হয়েছে। ১৯৫৫ ও ১৯৬৪ সালের বন্যায় বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তাছাড়া ১৯৭০, ১৯৭৪ ও ১৯৮৮ সালে ঘটা বন্যাও আমাদের দেশের মানুষের মধ্য অত্যন্ত কষ্টকর ও খারাপ প্রভাব বিস্তার করে।  আবার ১৯৯৮ সালেও ঘটে বন্যা যা অনেক দীর্ঘস্থায়ী ছিল।এ সময় অপরিবর্তিত অবস্থায় বাংলাদেশের মানুষকে প্রায় ৫ মাস পানিবন্দি জীবন-যাপন করতে হয়েছে। ২০০১, ২০০২ ও ২০০৭ সালে ঘটা বন্যাও মানুষ, গবাদি পশু ও ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছে। তাছাড়া এর ফলে অনেক মানুষ তাদের প্রাণ হারিয়েছে এবং বাংলাদেশে প্রতিবছরই কম-বেশি প্রায় অনেক মানুষ বন্যার কারণে মারা যায়।

    ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস

    বাংলাদেশে  প্রায় প্রতি বছরের এপ্রিল-মে ও অক্টোবর-নভেম্বরের মাসের দিকে ছোট-বড় নানা ধরনের ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় বাতাসের তীব্রতা অনেক বেশি থাকে। এর ফলে কখনো কখনো সমুদ্রের জলোচ্ছাসের সৃষ্টি হয়। এ ধরনের দুর্যোগ প্রায় প্রতিবছরই কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী বরিশাল, খুলনা প্রভৃতি উপকূলবর্তী এলাকায় ও দ্বীপসমূহে আঘাত হানে। এর নিষ্ঠুর আঘাতে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে থাকে ও আশ্রয়হীন হয় লক্ষ লক্ষ মানুষ। আশ্রয়হীন লোকেরা বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে শরণাপন্ন হয়। তখন মানুষ পতিত হয় অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশায়। লবণাক্ততার জন্য এলাকার ভূমি চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ে বা চাষ করলেও ভালো ফসল পাওয়া যায় না। এই ফসলের ক্ষয়ক্ষতির কারণে কৃষি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। ১৯৭০ সালে ঘটা মেঘনার মোহনায় প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে প্রায় দেড় লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। ২০০৭ সালে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আঘাত হানে 'ঘূর্ণিঝড় সিডর'। ২০০৯ সালের 'ঘূর্ণিঝড় আইলা' দেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সৃষ্টি করে। 'ঘূর্ণিঝড় আইলার' কারণে বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ও ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া এসব ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দেশের অভ্যন্তরে ও অপূরণীয় ক্ষতি হয় যা দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবনতি বয়ে আনে।

    নদী-ভাঙ্গন

    বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। এদেশে প্রায় ১৩ শত নদী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। নদীর ধর্মই হলো এক কূল ভাঙা এবং নতুন  কূল সৃষ্টি করা। নদীর এই ভাঙা-গড়ার খেলায় এদেশের মানুষকে গৃহহীন হতে হয়। নদীর তীরে বাস করা মানুষের ঘরবাড়ি সহায়-সম্বল নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এ দুর্যোগের কবলে পড়ে মানুষ যাযাবর জীবন যাপন করে এবং কিছুকালের জন্য গৃহ এবং ঠিকানাবিহীন হয়ে যায়।

    ভূমিকম্প

    অন্যান্য দুর্যোগের মত ভূমিকম্প বাংলাদেশেও মাঝে মাঝে আঘাত হানে। এটি অল্প সময়ে অত্যাধিক ক্ষতি করে। ভূমিকম্পের মাত্রা বেড়ে গেলে ঘরবাড়ি রাস্তাঘাট ভেঙে পড়ে। তাতে যোগাযোগ ব্যবস্থার অবনতি ঘটে এবং অনেক এলাকা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তবে গত ১০০ বছরে বাংলাদেশে মারাত্মক কোন ভূমিকম্প ঘটেনি। তবে অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে যে কোন সাধারন ভূমিকম্পেও বড় বড় শহরগুলো মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। 

    ভূমিধস ও ভূমিক্ষয়

    ভূমিধস বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা সাধারণত পাহাড়ি এলাকায় সংঘটিত হয়। বাংলাদেশে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দারবান, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার, সিলেট, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা প্রভৃতি পাহাড়ি অঞ্চলে  প্রায় প্রতিবছর ভূমিধস ঘটে থাকে। পাহাড়ের গায়ে অপরিকল্পিতভাবে গৃহ নির্মাণের কারণে ভূমিধসে অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে থাকে। প্রবল বায়ুপ্রবাহ, অধিক বৃষ্টিপাত, নির্বিচারে গাছ কাটা ও পাহাড় কাটা ভূমিধসের মূল কারণ। এইরকম আরেকটি দুর্যোগের নাম হচ্ছে ভূমিক্ষয়। ভূমিক্ষয়ের কারণে প্রত্যক্ষভাবে মানুষের ক্ষতি হয় না তবে তা দীর্ঘ মেয়াদে ঘটলে মানুষকে অনেক বড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। ভূমিক্ষয়ের প্রধান কারণ হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে বনের গাছ কেটে ফেলা। মাটিকে ক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে গাছের ভূমিকা অপরিসীম। এই গাছ কেটে ফেলার কারণে প্রবল বর্ষণের ফলে মাটির উপরের স্তর ক্ষয় হয়ে যায় এবং এতে শুধু ভূমির উচ্চতাই নয় বরং জমির উর্বরতা নষ্ট হয়। 

    অগ্নিকাণ্ড বা দাবানল 

    অগ্নিকাণ্ড যেমন মানবসৃষ্ট কারণে ঘটে তেমনি ভাবে প্রাকৃতিক ভাবে এটি ঘটে থাকে। প্রচণ্ড দাবদাহে কারণে বিভিন্ন দেশের বনাঞ্চল এজে অগ্নিকাণ্ড ঘটতে দেখা যায় তাকে দাবানল বলে। এর ফলে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়। বাংলাদেশ দাবানল ঘটে না বলে একে ঠিক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলা যাবে না। 

    দুর্যোগ মোকাবেলা ও প্রতিকার

    দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকার সবসময়েই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। এজন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো নামে সরকারের একটি সংস্থা রয়েছে। প্রচার মাধ্যমগুলো দুর্যোগকালে পূর্ব প্রস্তুতি ও সম্ভাব্য মোকাবেলার বিষয়টি দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে পর্যন্ত সম্প্রচারের ব্যবস্থা করে। দুর্যোগের আগে ও পরে সরকারের সবগুলো সংস্থা সতর্ক থাকে যাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যথাসাধ্য কমিয়ে রাখা যায়।

    উপসংহার

    একসময়ে মানুষ প্রকৃতির খেয়াল খুশির ওপর নিজেদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হতো। কিন্তু মানুষ এখন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করার কারণে আগে থেকেই অধিকাংশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের আভাস পেয়ে যায়। ভূমিকম্পের আগাম বার্তা এখনো আবিস্কার করা সম্ভব না হলেও ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে মানুষ এখন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগের আগাম খবর পায়। অচিরেই হয়তো ভূমিকম্পের আগাম বার্তা পেয়ে যাবে। আস্তে আস্তে হয়তো মানুষ এমন বিভিন্ন প্রযুক্তি আবিষ্কার করবে যা দিয়ে দুর্যোগের প্রায় ক্ষতিই এড়ানো সক্ষম হবে।

    এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

    পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
    3 জন কমেন্ট করেছেন ইতোমধ্যে
    • Anonymous
      Anonymous June 25, 2022 at 9:28 AM

      Thank you ❤️

      • Md. Shihab Uddin Mahi
        Md. Shihab Uddin Mahi June 25, 2022 at 11:34 AM

        You are most welcome❤️

    • Anonymous
      Anonymous October 5, 2023 at 6:36 PM

      Thank you

    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন
    comment url